Gausia Committee Bangladesh |
মুমিনদের ভয়াবহ পরীক্ষা
==========================================
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
রাসূলে পাক এরশাদ করেন, মানুষের মাঝে এমন
একটি যুগ আসবে, তাতে নিজের দ্বীনের উপর ধৈর্যধারনকারী আগুনের কয়লা আঁকড়ে
ধারনকারীর ন্যায় হবে। হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী
রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি উক্ত হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন: এই যুগ
কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে হবে, যা বর্তমানে শুরু হয়ে গেছে। এখন তো দ্বীনদার
হয়ে থাকা অনেকাংশে কঠিন। দাঁড়ি রাখা, নিয়মিত নামায আদায় করা কঠিন হয়ে গেছে।
সুদ থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভবই। যে সব ইসলামী বোন বোরকা পরিধান করে, শরয়ী
পর্দা করে এবং শরীয়ত অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করতে চায়, তারাও কখনো কখনো কঠিন
পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। যে সব ইসলামী ভাই সুন্নাতের ধারক হয়ে শরীয়তের
অনুসরণ করতে চায়, বিশ্বস্ততার সাথে নিজের অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করে সুদ ও
ঘুষের উপদ্রব হতে বিরত থেকে হালাল উপার্জন করতে চায়, তারাও কঠিন পরীক্ষার
সম্মুখীন হয়। যারা শরীয়তের গন্ডির মধ্যে থেকে না-জায়েয রীতিনীতি হতে বিরত
থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চায়, তারাও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। একদিকে তো
সমাজের লোকেরা তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে উত্যক্ত করে, তাদের মনে কষ্ট দেয় এবং
তাদের সাহস কমানোর চেষ্টা করে থাকে আর অপরদিকে নেক আমল করার ক্ষেত্রে নাফস ও
শয়তান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তিনি আরো বলেন: যেমনটি হাতে জ্বলন্ত কয়লা
রাখা অনেক বড় ধৈর্যশীলের কাজ, তেমনিভাবে সেই সময় একনিষ্ঠ ও পরিপূর্ণ
মুসলমান হওয়া খুবই কঠিন হয়ে যাবে।
মানুষের ভুল হতেই পারে কিন্তু আফসোস! যদি
কোন ধর্মীয় অনুশাসন পালনকারী ব্যক্তির কোন ভুল হয়ে যায় তবে তা নিয়ে খুবই
আস্ফালন করা হয়, অনুরূপভাবে স্যোশাল মিডিয়া এবং অন্যান্য মাধ্যমে বিভিন্ন
ভাবে ইসলামের অনুসারীর বদনাম করার অপচেষ্টা করা হয়ে থাকে, যাতে মানুষের মনে
তাঁদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়, ফলশ্রুতিতে লোকেরা তাঁদের প্রতি কু-ধারণা
পোষণ করে, তাঁদেরকে গুরুত্ব দেয় না এবং নিজের দুনিয়া ও আখিরাতকে ধ্বংসের
উপলক্ষ তৈরী করে। এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে দ্বীনের অনুসারী ইসলামী ভাই ও
বোনদের আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ। তবে সতর্কতার পরও প্রতিবন্ধকতা হলে, লোকেরা
কটাক্ষ করলে বা পরিবারের সদস্যরা সুন্নাত অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করতে বাধা
দিলে তবুও ঘাবড়ানো যাবে না, কেননা যেই কাজে কষ্ট বেশি, তাতে সাওয়াবও বেশি
হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ
করেন: সর্বোত্তম ইবাদত হলো, যাতে কষ্ট বেশি হয়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র ইরশাদ করেন: যে ব্যক্তি আমার উম্মতের ফিতনা
ফ্যাসাদের সময় আমার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরলো তবে তার একশত শহীদের সাওয়াব
অর্জিত হবে। কেননা, শহীদরা তো একবার তরবারির আঘাতেই পার পেয়ে যান; কিন্তু
আল্লাহ তাআলার এই বান্দারা সারা জীবন মানুষের ভৎর্সনা ও মুখের আঘাত পেতেই
থাকে। আল্লাহ তাআলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
সন্তুষ্টিতে সবই সহ্য করে থাকে। তাদের জিহাদ হলো জিহাদে আকবর (নাফসের
বিরুদ্ধে জিহাদ)। যেমন এই যুগে দাঁড়ি রাখা, সুদ থেকে বাঁচা ইত্যাদি।
হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খান
নঈমী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি হাদীস শরিফের আলোকে বলেন: কিয়ামতের
নিকটবর্তী সময়ে এমন লোক বের হবে, যারা নিজের নেকীসমূহ প্রকাশ করা পছন্দ
করবে, যাতে লোকেরা তাদের বাহবা দেয়। একাকী হয়তো আমল করবেই না, করলেও তা
সাধারণভাবে করবে। (তিনি আরো বলেন:) সেই লোকদের মনে আল্লাহ তাআলার ভয়,
আল্লাহ তাআলার প্রতি আশা থাকবে না বা কম থাকবে, মানুষের ভয়, মানুষের প্রতি
আশা তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। এই মহান বাণীতে আলেম-ওলামা,
ইবাদতকারী, দুনিয়ার প্রতি উদাসীন, দানশীল-সবাই অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত প্রতিটি
আমল একনিষ্ঠতাতেই কবুল হয়। এতে তারাও অন্তর্ভুক্ত, যারা মানুষকে প্রকাশ্যে
ভালবাসবে এবং তাও কোন উদ্দেশ্যে, যখন উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে বন্ধুত্বও
শেষ হয়ে যায়। বর্ণিত আছে, আল্লাহ তাআলা একজন নবী আলাইহিস সালামের নিকট ওহী
প্রেরণ করেন: অমুক যাহিদকে (অর্থাৎ দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতা অবলম্বনকারীকে)
বলে দিন যে, (আল্লাহ তাআলা বলেন,) তোমার দুনিয়ার প্রতি উদাসীনতা অবলম্বন
করা তো নিজের নাফসকে প্রশান্তি দেয়ার জন্য এবং সবার থেকে আলাদা হয়ে আমার
সাথে সম্পর্ক রাখাও তোমার সম্মানের জন্য, তোমার প্রতি আমার যা কিছু হক
রয়েছে, তার বিনিময়ে কি আমল করেছো? আবেদ লোকটি আরয করলো: হে প্রতিপালক! সেই
আমল কি? ইরশাদ করলেন: তুমি কি আমার কারণে কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করেছো এবং
আমার কারণে কোন অলীর সাথে বন্ধুত্ব করেছো? অতএব আমাদের উচিৎ যে, সব ধরনের
জায়েয সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিকেই অগ্রাধিকার দেয়া। বস্তুত সে-ই
সৌভাগ্যবান, যে আল্লাহ তায়ালার জন্য পরস্পরে বন্ধুত্ব রাখে। কেননা হাদীসে
পাকের বর্ণনা অনুযায়ী এরূপ লোকেরা পরিপূর্ণ ঈমানদার এবং আল্লাহ তাআলা তাদের
কিয়ামতের দিন একত্র করে দিবেন, সেই সৌভাগ্যবানরা আরশের পাশে ইয়াকুতের (এক
প্রকার মূল্যবান পাথর) চেয়ারে থাকবে এবং জান্নাতে ইয়াকুতের স্তম্ভ সম্বলিত
জরবজদ (পান্না) পাথরের কক্ষে তাদের ঠিকানা হবে।
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন: মানুষের মাঝে একটি যুগ এমন আসবে যে, ঐ ব্যক্তি
ছাড়া কোন দ্বীনদারের দ্বীন নিরাপদ থাকবে না, যে নিজের দ্বীন নিয়ে (অর্থাৎ
এর নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে) একটি পাহাড় থেকে অরেকটি পাহাড়ে এবং একটি গুহা
থেকে আরেকটি গুহার দিকে পালাবে। সেই সময় আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি ব্যতিত
রুজি উপার্জন করা সম্ভব হবে না। আর তখন লোকেরা নিজের স্ত্রী-সন্তানদের
হাতেই ধ্বংসে পতিত হবে, যদি-স্ত্রী সন্তান না থাকে তবে পিতামাতার হাতেই তার
ধ্বংস হবে এবং যদি পিতামাতাও না থাকে তবে তার ধ্বংস আত্মীয় বা
প্রতিবেশিদের হাতেই হবে। সাহাবায়ে কিরাম আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা
কিভাবে হবে? তখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
তারা তাকে স্বল্প রোজগারের কারণে লজ্জিত করবে, তখন সে নিজেকে ধ্বংসের
স্থানে নিয়ে যাবে।
উপরোক্ত হাদীস শরীফে বিশেষত ঐ সকল
মহিলাদের জন্য দিক-নির্দেশনা রয়েছে, যারা নিজের স্বামীদেরকে তাদের স্বল্প
উপার্জনের জন্য অভিশাপ দিয়ে বলে যে, “অমুকের নিকট তো অনেক বাংলো, ফ্যাক্টরী
এবং জায়গা-সম্পত্তি রয়েছে কিন্তু তুমি আমাকে ছোট একটি ভাড়া বাসায় রেখেছো,
আমার তো এখানে দম বন্ধ হয়ে আসে, আমার খোলামেলা বাড়ি চাই। অমুকের দিকে তাকাও
নিজের পরিবার নিয়ে আলিশান গাড়িতে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু আমাকে বাস, টেক্সী আর
রিক্সার থাক্কা খেতে হয়। অমুক তো লোড শেডিং থেকে বাঁচার জন্য জেনারেটর কিনে
নিয়েছে আর তুমি কমপক্ষে চার্জিং ফ্যান হলেও কিনে নাও। অমুক তো এই ঈদে তার
সন্তানের মাকে এত হাজার টাকার পোশাক বা সোনার সেট বানিয়ে দিয়েছে কিন্ত তুমি
আমাকে ঈদে সোনার আংটি বা কানের দুল তো বানিয়ে দাও, অমুকের বেতন লাখ টাকা
কিন্তু তুমি এতদিন কাজ করার পরও একই জায়গায় আছো” ইত্যাদি, আর সন্তানদের
আবদার তো আছেই। নিত্যদিন যখন একজন লোক আবদার এবং কটুক্তি শুনতে থাকে তখন
মানসিক কষ্ট এবং অসহায়ত্ব তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে নেয়, তার কিছুই বুঝে আসে
না যে, সে এখন কি করবে, যেহেতু তার স্ত্রী-সন্তানের আবদার পূরণ করতে হবে
কিন্তু তার নিকট সুযোগও কম। সুতরাং সে তাদের আবদার পূরণ করার জন্য হারাম ও
হালালের পার্থক্য না করেই না-জায়েয পথ অবলম্বন করে নিজের পরকালকে নষ্ট করে
দেয়। এ প্রসঙ্গে নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
মানুষের মাঝে এমন একটি যুগ আসবে যে, সে (সম্পদ) কোথা হতে অর্জন করলো, তা
হারাম নাকি হালাল ওই বিষয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ থাকবে না। হাকীমুল উম্মত হযরত
মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি তাআলা আলাইহি উক্ত হাদীস শরীফের
ব্যাখ্যায় বলেন: মানুষ দ্বীনের প্রতি অসাবধান হয়ে যাবে, পেটের চিন্তায়
চারিদিকে ফেঁসে যাবে, উপার্জন বৃদ্ধি, সম্পদ জমা করার চিন্তা করবে, হারাম ও
হালাল পার্থক্যকরণে ভীতিহীন হয়ে যাবে, যেমনটি আজকাল দেখা যাচ্ছে। [মিরাতুল
মানাজিহ, ৪/২২৯]
সুধী, মনে রাখবেন! যেই পরিবারের জন্য
আমরা দিনরাত উপার্জন করি, তারাই কাল কিয়ামতে আমাদের অপদস্ততার কারণ হতে
পারে। যদিও পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান এবং আত্মীয়দের হক আদায় করা নিঃসন্দেহে
আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে, কিন্তু যদি আমরা তাদের চাহিদা পূরণ করা এবং
তাদের কটুক্তি থেকে বাঁচার জন্য হারাম ও হালালের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই
সম্পদ উপার্জন করতে থাকি, বিপদের সময় তাদেরকে ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, অল্পে
তুষ্টি এবং আল্লাহ তাআলার প্রতি ভরসা করার মানসিকতা না দিই এবং হালাল ও
হারামের পার্থক্য না শিখাই তবে হতে পারে যে, কাল কিয়ামতের দিন তারাই আমাদের
বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালার দরবারে নালিশ করবে এবং আমরা ফেঁসে যাব। তারা আরয
করবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এই ব্যক্তি থেকে আমাদের হক আদায় করে
দিন। কেননা, সে কোন দিন আমাদের দ্বীনি বিষয়ে শিক্ষা দেয়নি এবং সে আমাদের
হারাম খাবার খেতে দিয়েছিলো, যা আমরা জানতাম না। অতঃপর সেই ব্যক্তিকে হারাম
উপার্জনের জন্য এমনভাবে মারা হবে যে, তার মাংস ঝরে যাবে। অতঃপর তাকে
মীযানের নিকট নেয়া হবে, ফিরিশতারা পাহাড় পরিমাণ তার নেকী নিয়ে আসবে তখন তার
সন্তানদের মধ্যে একজন অগ্রসর হয়ে বলবে: “আমার নেকী অল্প” তখন সে এই
নেকীসমূহ থেকে নিয়ে নিবে, অতঃপর আরেকজন এসে বলবে: “তুমি আমাদের সুদ
খাইয়েছো” এবং তার নেকীসমূহ থেকে নিয়ে যাবে, এমনিভাবে তার পরিবারের লোকেরা
তার সব নেকী নিয়ে নেবে এবং সে তার পরিবার পরিজনদের দিকে দুঃখ ভারাμান্ত ও
অসহায়ভাবে তাকিয়ে বলবে: “এখন আমার ঘাঁড়ে সেই গুনাহ ও অত্যাচার সমূহ রয়ে
গেছে, যা আমি তোমাদের জন্যই করেছিলাম।” ফিরিশতা বলবে: “সে ঐ দূর্ভাগা
ব্যক্তি, যার নেকী সমূহ তারই পরিবারের লোকেরা নিয়ে গেছে এবং সে তাদেরই
কারণে জাহান্নামে চলে গেলো।” [আর রওযুল ফায়েক, ৪০১ পৃ:]
0 Comments