Recents in Beach

Gausia Committee Bangladesh বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গাউসে যমান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহঃ)


বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গাউসে যমান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহঃ)
----------------------------------
শাহ্‌জাহান মোহাম্মদ ইসমাঈল
---------------------------------------
প্রাক কথন - বাংলাদেশের সাথে পীরে কামেল হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহঃএর ছিল আত্মার সম্পর্ক। ১৯৫৮ সালের শাবান মাসে তিনি প্রথম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শুভাগমন করেন। এবং আন্দরকিল্লাস্থ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস ভবনে স্বীয় পিতার সাথে আতিথ্য গ্রহন করেন। সে বছর রমজান মাসে আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদে সুললিত কণ্ঠের কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বিশ রাকাত তারাবীর নামাজে ইমামতি করেন। তাঁর সুমধুর কন্ঠের তিলাওয়াত উপস্থিত মুসল্লিদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। একই বছর তিনি রেয়াজুদ্দিন বাজারস্থ শেখ আফতাবুদ্দিন সাহেবের কাপড়ের দোকানে পবিত্র খতমে গাউসিয়ার মাহফিলে কাদেরিয়া তরীকার খিলাফাত প্রাপ্ত হন। এভাবে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তাঁর এদেশে আসা যাওয়ার কর্মসুচী। ফলে এদশে তাঁর মুরীদ সংখ্যা প্রায় দাড়ায় প্রায় লক্ষাধিক। এবারে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এর সময়ে গাউসে যমান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহঃ এর ভূমিকা আলোচনা করবো।
১। “১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ ছিলেন, তখন তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শাহ্ আহমদ নূরানী ( বর্তমনে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের প্রধান ) কে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া খান নিকট পাঠিয়ে বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচার বন্ধ করুন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তাঁর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করুন। পাকিস্তানকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করুন। পরবর্তীকালে তিনি নওশেরায় বন্দী শিবিরে আটক সেনাবাহিনীর বাঙালী সদস্যদের দেখতে যান এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে সহায়তা করেন ও আশু মুক্তির জন্য দোয়া করেন”।
সূত্র - আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাঃ – জীবন ও কর্ম- মোহাম্মদ আবদুল অদুদ, আল্লামা তৈয়ব শাহ্ (রা:) স্মারক গ্রন্থ পৃষ্টা নং ৩৯, প্রকাশকাল -১৯৯৪ ইং, প্রকাশক- আল্লামা তৈয়্যবিয়া সোসাইটি, বাংলাদেশ।
২। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধকালীন সময়ে গাউসে যমান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহঃ তাঁর বাংলাদেশি মুরীদানদের অবস্থা ও কুশল নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন। তাই সে সময়ে তিনি এক পত্র মারফত তাঁর মুরীদদেরকে এই দোয়া সকাল-বিকাল রোজ তিনবার করে পাঠ করার নির্দেশ দেন। দোয়াটি এই –
“বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআ ইসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামায়ি ওয়া হুয়াস সামীউল আলীম”।।
অর্থ - মহা পবিত্র সত্তা ঐ আল্লাহ্র নামে শুরু করলাম, যাঁর নামের বদৌলতে জমিনে বা আসমানে কোন বস্তুর (মানব, জ্বীন বা শয়তান এর) ক্ষতি করার কোন ক্ষমতা নাই। তিনি সব কিছু শুনেন ও জানেন।
উপকারীতা ঃ
১। পবিত্র গ্রন্থ “মিশকাত শরীফ” এ বর্ণিত এক হাদীসে আছে, হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ দোয়া সকালে তিন বার এবং সন্ধ্যায় তিনবার পাঠ করবে, কোন শত্রুই তার কোন রকম অনিষ্ট করতে পারবে না”।
২। অপর এক হাদীসে আছে, হযরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, “ এ দোয়াটি সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যায় পড়লে সকাল পর্যন্ত কোন বিপদাপদ বা দুর্ঘটনা তার উপর আসবে না”।
আলহামদুলিল্লাহ্ মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে কত দয়ালু পীর নসীব করেছেন।।
৩। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার বেশ কয়েক মাস আগে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সর্বশেষ সফরের এক পূন্য মুহুর্তে তিনি আমার সম্মানিত পিতা ঢাকা আঞ্জুমানের তৎকালীন সহ সভাপতি জনাব হাজী সিয়াজুল ইসলাম সওদাগর সাহেবকে বলেন, “হাজী সাহাব! গহিরামে (আমাদের গ্রামের বাড়ী) আপকা এক মাকান হোনা বহুত জরুরী হ্যায়”। সে মোতাবেক আমার আব্বা হুজুর আমাদের গ্রামের বাড়ী চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানাধীন গহিরা গ্রামে নিজের বাপের ভিটায় বাড়ী বানানো শুরু করেন। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই আমাদের বাড়ী নির্মানের কাজ সমাপ্ত হয়। আসলে আমার বাবার প্রতি এটা ছিল মুরশীদে বরহক গাউসে যমান হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ্ রাহঃ এর এক আগাম সাবধান বাণী।। সুবহানল্লাহ! মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে কত দয়ালু পীর নসীব করেছেন।
৪। এখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে শাহানশাহে সিরিকোট এর ভবিষ্যৎ বাণী উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। ইংরেজি ১৯৫৮ সালের কথা। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় দাদা হুযুর কেবলা চট্টগ্রামে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের বাসায় আছর/মাগরীব নামাজের জন্য অপেক্ষমান। খাদিম সাহেব নামাজের জন্য তাঁর দিকে জায়নামাজ এগিয়ে দিলেন।হঠাৎ তিনি রাগত স্বরে কী যেন বিড় বিড় করে বলতে বলতে জায়নামাজ ছুড়ে ফেলে দিয়ে পায়চারী করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মন একটু শান্ত হয়ে এলে তিনি যথারীতি নামাজের ইমামতি করলেন। উপস্থিত সবাই ভয়ে অস্থির। না জানি আমাদের আবার কী বেয়াদবি হয়ে গেল। নামাজের পর খাদেমের পীড়াপীড়িতে তিনি বললেন, “দেখ আমি পবিত্র আরশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম আজ থেকে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ কায়েম হবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। তাই আমি অত্যন্ত মনক্ষুন্ন হয়ে বলছিলাম যে, এই যদি আপনার ফায়সালা হয়, তবে আমরা এত কষ্ট করে কেন পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করলাম”? এ ঘটনা ঢাকা আঞ্জুমান কমিটির সম্মানিত জয়েন্ট সেক্রেটারী জনাব মিজানুর রহমান সাহেব বর্ণনা করেছেন।
৫। মুরশীদে বরহক হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলায়হি আজীবন সুন্নতের প্রতি অটল ও নীতির প্রশ্নে অবিচল ছিলেন। দুনিয়াবী কোন লোভ-লালসা বা প্রভাবপ্রতিপত্তি লাভের আশা কখনো তাঁর পবিত্র অন্তরে ঠাঁই করে নিতে পারে নাই।প্রসঙ্গতঃ এখানে হুজুর কিবলার (রহঃ) ঢাকা অবস্থানকালীন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি -
১৯৮১/৮২ সালের কথা। হুজুর কিবলা (রহঃ) তখন মোহাম্মদপুরর মাদ্রাসা সংলগ্ন খানকার দোতলায় অবস্থান করছিলেন। রোজকার মত বাদ আছর হুজুর কিবলাকে (রহঃ) বিকেলের চা-নাস্তা পরিবেশন করা হল। নেতৃস্থানীয় পীর ভাইয়েরা এবং মুরুব্বীরা হুজুর কিবলার (রহঃ) সামনে হাজির আছেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার সাহেব তখন দেশের প্রেসিডেণ্ট পদে আসীন। (তাঁর পি,এস,জনাব শাহজাহান চৌধুরী সাহেব স্বপরিবারে তাঁর শ্বশুর সহকারে আমার হুযুর কিবলার (রহঃ) মুরীদ। তাঁর গ্রামের বাড়ী চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায়। তিনি আমার নিকটাত্মীয়ও বটে)। যাই হোক, একদিন বিকেলে আছরের নামজের পর শাহজাহান চৌধুরী সাহেব এসেছেন হুজুর কিবলাকে (রহঃ) প্রেসিডেন্ট সাত্তার সাহেবের পক্ষ থেকে বঙ্গভবনে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাতে। সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সাহেবের একজন ব্যক্তিগত স্টাফও এসেছেন, হুজুর কিবলাকে (রহঃ) সালাম জানাতে। কথাটা হুজুর কিবলাকে (রহঃ) জানানো মাত্রই হঠাৎ তাঁর পবিত্র চেহারায়ে মুবারাক রাগে লাল ও গম্ভীর হয়ে গেল। হুজুর কিবলা (রহঃ) তাঁর পাশে বসা ঢাকা আঞ্জুমানের সহ-সভাপতি হাজী সিরাজুল ইসলাম সওদাগর সাহেব, আঞ্জুমানের সেক্রেটারী আলহাজ চিনু মিয়া সাহেব, হাজী আশরাফ আলী সাহেব, জনাব এবি চৌধুরী সাহেব ডাক্তার সাইদুজ্জমান চৌধুরী সাহেব, মতিউর রহমান সাহেব এবং উপস্থিত সকল পীর ভাইদেরকে লক্ষ করে বললেন, “মেরা ক্যায়া তাল্লুক হ্যায় উসছে? আগার মুজেহ মিলনা তো উসে এয়াহা আনা হ্যায়, ম্যায় কিসি কা পাস নেহি যাতা।” অর্থাৎ - “তাঁর সাথে আমার কীসের সম্পর্ক? যদি আমার সাথে কারো দেখা করার ইচ্ছা হয়, তবে সে যেন এখানে আসে, আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি কারো কাছে যাব না।”। হুজুর কিবলার (রহঃ) এ কঠিন চেহারা দেখে, হাজী সিরাজুল ইসলাম সওদাগর সাহেব, আলহাজ চিনু মিয়া সাহেব, হাজী আশরাফ আলী সাহেব আর এবি চৌধুরী সাহেব (হবিগঞ্জ বাড়ী, ইনি দাদা হুজুর কেবলার মুরীদ,সদ্য প্রয়াত) তো একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তাঁরা বার বার হুজুর কিবলার (রহঃ) পায়ে পড়ে মাফ চেয়ে নিচ্ছেন। আর অনুনয় করে বলছেন, “হুজুর!দয়া করে বেয়াদবী মাফ করে দিন!! ভবিষ্যতে এ রকম ভুল আর কক্ষনো হবে না।” এর অনেকক্ষণ পর হুজুর কিবলার (রহঃ) মন নরম হয়ে এল। তিনি চা পানে মনোনিবেশ করলেন। আমার হুজুর কিবলা (রহঃ) আজকালকার জামানার দুনিয়াদার আর দশজন পীর সাহেবদের মত ছিলেন না। মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়ালা আলিহি ওয়াসাল্লাম কে রাজী খুশী করাই ছিল তাঁর একমাত্র ভাবনা। মুরিদ করার সময় তিনি সকলকে এ মর্মে ওয়াদা করতে বলতেন যে, “ভবিষ্যতে আমি ঐ কাজ করব যাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়ালা আলিহি ওয়াসাল্লাম রাজী হন। আর ঐ কাজ করা থেকে বিরত থাকব যে কাজে আল্লাহ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়ালা আলিহি ওয়াসাল্লাম নারাজ হন।” এসবই ছিল মুরশীদে বরহক হযরতুল আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্‌ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলায়হির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহ্‌ পাক আমাদেরকে কত উঁচু মর্যাদাবান পীর নসীব করেছেন!!

Post a Comment

0 Comments